Saturday, March 31, 2012

শেয়ার বাজারের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সরকার

আবার আমরা ভাসতে ভাসতে ভাষার মাসে ভাসা-ভাসা জ্ঞান নিয়ে, ভাষার যুক্তি মুখে নিয়ে আশার কথা বলতে এসেছি। মানুষ বলে কথা, ভাসতে পারি তাই বলে তো কিনারায় চাপার আশা তো ছাড়তে পারি না। তাই শত উৎকট ভাষার নির্যাতনেও ভাষাকে নিয়ে হাসাহাসি আর ভালোবাসাবাসি এখনো বন্ধ করে দিইনি। নিত্যদিন কত রঙের, কত ঢংয়ের ভাষার সঙ্গে আমাদের মিশতে হয়, মেশাতে হয়, শুনতে হয়, শোনাতে হয়। তাই বলে কি সর্বক্ষেত্রে প্রমিত উচ্চারণ, শুদ্ধ বয়ান সম্ভব হয়? না! তা সম্ভব নয় । কিন্তু জগাখিচুড়ি তো নিশ্চয়ই নয়?
৪৯টি সাংকেতিক চিহ্নের সমন্বয়ে আমার অহংকারের বর্ণমালা। আজ যেটিকে বলা হয় দুঃখিনী বর্ণমালা। বর্ণের সমন্বয়ে তৈরি হয় অক্ষর। অক্ষরের সমন্বয়ে ধ্বনি। আর অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টি ভাষা। আর সেটি হচ্ছে, আমার মাটির, মায়ের, ভাইয়ের প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা। এই ভাষাকে নিয়ে যত ভাব-ভালোবাসা, আশা-প্রত্যাশা, হতাশা-দুর্দশা। আমার দেশের নতুন প্রজন্মের উদাসীনতার কারণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ-সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার আজ এই দশা। পৃথিবীর প্রায় ছয় হাজার ভাষার মধ্যে শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে বাংলা ভাষার অবস্থান প্রথম। বিভিন্ন ভাষার মানুষের সংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ। যেখানে পৃথিবীতে ইংরেজি শব্দের সংখ্যা ৮০ হাজার; সেখানে বাংলা ভাষার শব্দের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার। সম্প্রতি Oxford English Dictionary-তে লাঠিচার্জ, ধর্মঘট, হরতাল, ব্যারিকেড, আগ্রাসন ইত্যাদি শব্দ স্থান পেয়েছে। যা আমাদের মাতৃভাষার জন্য ইতিবাচক। আমার দেশের নবীন প্রজন্ম নিজেদের ওভার স্মার্ট হিসেবে প্রকাশ করার জন্য বারো মিশালি ভাষা ব্যবহার করে। যা তাদের দক্ষতা, ভদ্রতা, সভ্যতা নয় বরং সংকীর্ণতাই প্রকাশ পায়। আমরা এক উদ্ভট-উদভ্রান্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়, ‘এক উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ যেখানে আমরা যুব সমাজ মাটি, মাতৃভূমি, দেশীয় শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির মূল ছেড়ে বিদেশি সংস্কৃতির চুল ধরে টানাটানি করছি। তাই বলে আমি বিদেশি সংস্কৃতিবিদ্বেষী হওয়ার কথা বলছি না। আমরা যদি বিদেশি শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান গ্রহণ করতে পারি। সংস্কৃতি কেন গ্রহণ করব না? অবশ্যই করব এবং সেটি হবে পরিমিত মাত্রায়। অশ্লীল ও বিরক্তির কারণ যেন তা না হয়।
আমরা বাঙালিরা একটি বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও ফ্যাশনেবল। বিশেষ কোনো দিন, ক্ষণ বা মাস আসলে আমরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ, দেশপ্রেমী ও ষোলো আনা বাঙালি হয়ে যাই। যেমন ফেব্রুয়ারি এলেই ‘অ, আ, ই ,ঈ’ খচিত পোশাক পরিধান করি। মোবাইলে ভাষাবিষয়ক গান ও রিং টোন ডাউনলোড করি। কম্পিউটার কিংবা মোবাইল স্ক্রিনের থিম পরিবর্তন করি। কেউ ইংরেজি বললে ধমক দিয়ে বলি, ‘এই ব্যাটা..! ভাষার মাসে ইংরেজি বলিস কেন? ভাষার ইজ্জত খাবি তুই।’ বাংলা ভাষার প্রতি তখন একটা দরদ জন্ম নেয়। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় যেন মাথা নুয়ে পড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে গর্ব অনুভব করি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ গান গেয়ে বুক ফুলিয়ে তুলি। ভাষা নিয়ে বড়াই করি, বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে দাবি করে বক্তৃতা দিয়ে, সেমিনার করে ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করি। আর দশক-দশক ধরে বাংলা বানান, উচ্চারণ, শব্দ চয়ন ও প্রক্ষেপণে ভুল করি। প্রমিত, চলিত, শব্দমিশ্রণে ভাষাকে দূষিত, কুলষিত ও বিকৃত করি। আর সেটাকেই বন্ধুমহল ও সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত করার চেষ্টা করি। হলিউড-বলিউডের চলচ্চিত্র দেখি। কথায় কথায় বাংলার সঙ্গে হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে বাংহিংলিশ [বাংলা-হিন্দি-ইংলিশ] ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের অনেক বেশি চটপটে, জ্ঞানী ও অত্যাধুনিক মনে করি।
আমরা বিশ্বাস করি, আজ থেকে ১০০ বছর আগে আমাদের এই ভাষা এ রকম ছিল না। নিশ্চয়ই ১০০ বছর পর এ রকম থাকবে না। ভাষার ধর্মই পরিবর্তন হওয়া। প্রতি সাড়ে ১৬ কিলোমিটার অন্তর অন্তর ভাষার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। স্থান, কাল-পাত্র ভেদে ভাষা পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয় যা স্বাভাবিক। তাই বলে তো ডিজুস প্রজন্মের বিদেশি ভাষার অত্যাচার-নির্যাতন মেনে নেওয়া যায় না। রবি ঠাকুরের কথায় , ‘আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর বিদেশি ভাষার পত্তন।’ ঠিক সেভাবেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষার ভিত মজবুত করে বহু ভাষা শিখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমরা সেটা ভুলে গিয়ে শুধু ইংরেজি ভাষাকে বর্তমান সময়ে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করি। এর পেছনে যুক্তি হচ্ছে , আজকাল অনেক চাকরির পরীক্ষায় বাংলাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে সরকার তথা নীতিনির্ধারক মহলেও কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই মায়াবি বর্ণমালাগুলো বেঁচে আছে বাঙালির ছলাকলায়, হেলা-অবহেলায়।
যা হোক, সময়ের প্রভাবে, মিডিয়ার প্রচারণায়, বয়সের তাড়নায় ইয়াং জেনারেশন ইস্টার্ন-ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়লেও এক দিন আমাদের ফিরে আসতে হয় লোকগীতি, লালনগীতি, রবীন্দ্র-নজরুলে। যখন আমরা ফিরে আসব তখন দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতিকে দেওয়ার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তেমনিভাবে আমরা যতই অন্য ভাষা নিয়ে লম্পঝম্প করি না কেন, প্রকৃতির টানে, হৃদয়ের টানে, ভাবের টানে, রক্তের টানে মাতৃভাষা বাংলার কাছে এসেই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজতে হয়। এই অর্থ খোঁজা যেন অর্থহীন না হয়। তাই সময় থাকতে সুসময়ের জন্য তরুণ প্রজন্মকে ভাসা ভাসা নয়, গভীর ভালোবাসা দিয়ে বাংলা ভাষাকে জয় করার এই তো সময়।

No comments:

Post a Comment